লিভার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।এখনি বদলান দৈনন্দিন কার্যক্রম।
শিল্পায়নের ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে বহুগুণে। এরই প্রেক্ষিতে শহরের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে ফাস্টফুড ও রেডিমেড ফুডের দোকান। ফলে সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। সুযোগ পেলেই বন্ধুবান্ধব মিলে চলে যাচ্ছে ফ্রাইড চিকেন কিংবা পেস্ট্রি খেতে, সাথে থাকছে নানা জাতের কোমল পানীয়। এসব খাবার অতিরিক্ত ক্যালরী ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ হয়। অল্প কিছুদিন নিয়মিত এই ধরণের খাবার খেলে তা লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমার কারণ হয়ে দাড়ায়, যা থেকে লিভার প্রদাহ হতে পারে। এই রোগটিকে চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা এনএএফএলডি। এনএএফএলডি থেকে লিভার প্রদাহ, লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। সুতরাং ফ্যাটি লিভার-এ আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে ফাস্টফুড পরিহার এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অতীব জরুরী।
আমরা কি খাচ্ছি শুধু তার উপরই যে আমাদের লিভারের সুস্থতা নির্ভর করে তা নয়। বরং, খাদ্য প্রস্তুত করতে কি উপায় অবলম্বন করছি তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমির নিচের দেশগুলোতে ‘উগালি’ নামক এক ধরণের খাবার তৈরী করতে লোহার কড়াই ব্যবহার করা হয়। খাবারটি প্রস্তুত করা হয় অম্লীয় অবস্থায়। ফলে দীর্ঘদিন উক্ত খাবার গ্রহণের ফলে শরীরে অতিরিক্ত আয়রণ প্রবেশ করে। এই অতিরিক্ত আয়রণ লিভারে জমা হয়ে সিডেরসিস নামক রোগ তৈরী করে। এলাকার নামানুসারে একে ‘বান্টু সিডেরসিস’ বলা হয়। অন্যদিকে ইন্ডিয়ায় পিতলের পাত্রে গরম কৃত দুধ খাওয়ানোর ফলে শিশুদের লিভারে অতিরিক্ত কপার জমা হয়ে সিরোসিস হওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে। একে ইন্ডিয়ান চাইল্ডহুড সিরোসিস বলা হয়।
আমরা যে ওষুধ সেবন করি তার প্রায় সবগুলোই খাদ্যনালী থেকে প্রথমে লিভারে প্রবেশ করে। লিভারে বিভিন্ন এনজাইমের সাহায্যে তা পরিবর্তিত হয়ে শরীরের উপযোগী হয়ে রক্তে সঞ্চালিত হয়। তবে কিছু কিছু ওষুধ স্বয়ং লিভারের কোষকেই ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন খাবারের মধ্য দিয়ে প্রবিষ্ট বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ এবং বিভিন্ন ভেষজ ওষুধও আমাদের লিভারকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। প্রতিটি ওষুধ-ই বাজারে ছাড়ার আগে মানুষের শরীরের জন্য প্রযোজ্য মাত্রা নির্ণয় করে ছাড়া হয়। ওষুধের নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করলে তা লিভারের ক্ষতি করে। আমাদের দেশে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, ব্যথার জন্য ডাইক্লোফেন জাতীয় ওষুধ এবং ইনফেকশনের জন্য এন্টিবায়োটিক-এর ব্যবহার হয় ইচ্ছে মত। অথচ নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে এবং লিভারের অবস্থা বিবেচনা না করে খেলে এগুলো বিভিন্নভাবে লিভার প্রদাহ করতে পারে। বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হলেও হতাশা, বিষাদ ও মানসিক অসুস্থতা আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে অতিরিক্ত হতাশা থেকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। যেহেতু উন্নত বিশ্বে বাজারে বিষ জাতীয় রাসায়ণিক দ্রব্য সহজলভ্য নয় ফলে ‘ওটিসি শপ’ থেকে প্যারাসিটামল কিনে আত্মহত্যা করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একজন ব্যক্তি একবারে দশ থেকে বারটি প্যারাসিটামল টেবলেট গ্রহণ করলে একিউট ফালমিনেন্ট হেপাটিক ফেইলিউর হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন ছাড়া এর কোন চিকিত্সা নেই। সুতরাং যে কোন ওষুধ সেবন করতে হবে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শক্রমে। এছাড়া শরীরের শক্তি বর্ধক, রোগ নিবারক, লিভার টনিক হিসেবে অনেক ধরণের ভেষজ (হারবাল) ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে আছে। এগুলোও বাছবিচার না করে খেলে লিভারকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। বিশেষ করে আমাদের সমাজে লিভারের প্রদাহে আক্রান্ত রোগীদের নান রকম গাছের পাতা, কাণ্ড ও মূল খাওয়ানো হয়। যা লিভারকে আরো ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। সুতরাং লিভার প্রদাহে আক্রান্ত হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে খাবার খাওয়া উচিত।
লিভার রোগে আক্রান্ত
রোগীদের খাবার
আমাদের সমাজে ভাইরাল হেপাটাইটিস-এ আক্রান্ত রোগীদের খাবার নিয়ে বিভিন্ন রকম কুসংস্কার বিদ্যমান। যেমন: হলুদ খাওয়া যাবে না এবং বেশী বেশী আখের রস খেতে হবে। প্রকৃতপক্ষে হেপাটাইটিস ভাইরাস দ্বারা স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহে আক্রান্ত রোগীরা স্বাভাবিক সব খাবারই খেতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে হেপাটাইটিস রোগীদের মূল চিকিত্সা হল বিশ্রাম এবং বাসায় রান্না করা স্বাভাবিক খাবার। যারা হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস জনিত দীর্ঘমেয়াদী লিভার প্রদাহে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রেও খাবারের কোন বাধা নিষেধ নেই।
খাবারের নিয়মনীতি আছে যারা লিভার সিরোসিস-এ আক্রান্ত তাদের জন্য। মাত্রার উপর নির্ভর করে সিরোসিস দুই ধরণের হয়- কমপেনসেটেড এবং ডিকমপেনসেটেড সিরোসিস। একজন সম ওজনের স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে সিরোসিস-এ আক্রান্ত রোগীর বেশী ক্যালরী গ্রহণের প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি ওজনের জন্য ২৫ থেকে ৩৫ কিলোক্যালরী শক্তি যুক্ত খাবার এবং প্রতি কেজিতে ১ থেকে ১.২ গ্রাম প্রোটিন খাবারের মেন্যুতে থাকতে হবে। প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টা পর পর হালকা খেয়ে নেয়া উত্তম। হালকা খাবারের মধ্যে টোস্ট, বিস্কিট, কেক, সেরিয়েল, দুধের তৈরী খাবার রাখা যেতে পারে। এছাড়া মল নরম রাখার জন্য বেশী আঁশ যুক্ত খাবার যেমন শাক সবজি খাওয়া দরকার। ডিকপেনসেটেড সিরোসিসের রোগীদের রক্তে অ্যালবুমিনের পরিমাণ কমে যায় এবং পেটে পানি চলে আসে। এই রোগীদের মল শক্ত হলে রক্তে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে রোগীর চেতনা হ্রাস হয়। এ কারণে ডিকমপেনসেটেড সিরোসিসের রোগীদের হিসেব করে পানি পান করতে হয়, খাবারে লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং শর্করা জাতীয় খাবার বেশী খেতে হয়। আগে মনে করা হতো প্রোটিন কম খাওয়া উচিত্, কিন্তু এখন লিভার বিজ্ঞানীরা বেশী প্রোটিন খাওয়ার ব্যপারে উত্সাহিত করেন। তবে, দৈনিক মোট প্রোটিনের পরিমাণ এক-দুইবারে না খেয়ে অল্প অল্প করে চার-পাঁচবারে খেতে বলা হয়।
অ্যালকোহলের কারণে সৃষ্ট লিভার রোগের মূল চিকিত্সা হল অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা। অন্যদিকে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ-এ আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপদেশ হল খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট-এর পরিমাণ কমিয়ে আনা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, ফাস্টফুড সংস্কৃৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট শরীরচর্চা করা।
লিভারে অতিরিক্ত আয়রণ জমা হয়ে হিমোক্রোমাটসিস হলে আয়রণ যুক্ত খাবার (যেমনঃ কলা, কচু, আয়রণ বডি) ইত্যাদি খাওয়া যাবে না। ভিটামিন সি যুক্ত ফল এবং ভিটামিন সি ওষুধ সেবন করতে হবে সীমিত পরিমাণে, কারণ এগুলো অন্ত্রে আয়রণ শোষণ বাড়ায়। ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। শুধু মাত্র লোহা দিয়ে তৈরী পাত্রে দুধ গরম করা ও খাবার রান্না করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
অতিরিক্ত কপার জমা হয়ে সৃষ্ট লিভার রোগ উইলসনস ডিজিজ-এ সাধারণত ডাক্তাররা কোন খাবার নিষেধ করেন না। তবে জেনে রাখা ভাল যে চকলেট, বাদাম ও মাশরুম-এ কপারের পরিমাণ বেশী থাকে।
উপসংহার
আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা সংক্ষেপে জানতে চেষ্টা করলাম, কিভাবে
নিজের খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললে লিভারকে সুস্থ রাখা যাবে, কি কি খাবারের কারণে লিভারে রোগ
হতে পারে এবং লিভার অসুস্থ হলে খাবারের ধরণ কেমন হওয়া চাই।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে পূর্ণভাবে জানা না গেলেও এ
সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া
যাবে বলে আশা করছি। আগ্রহী পাঠকগণ নিজ নিজ প্রয়োজনের আলোকে আরো বেশী জানতে ডায়েটিসিয়ান অথবা লিভার বিশেষজ্ঞ-এর সাথে আলোচনা
করলে ভালো দিকনির্দেশনা
পাবেন। তবে যতটুকু জানতে
পারলাম সেই আলোকে সচেতন
হয়ে সুস্থ লিভারের জন্য সুন্দর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলব, পাঠশেষে
তা-ই হোক আমাদের ব্রত।
-দ্য লিভার পরিচালক।ঢাকা।
0 Comments